দেশের শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দুই স্টক এক্সচেঞ্জের নেতারা। তাঁরা বলেছেন, বেশ কিছুদিন ধরে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে। যে কোম্পানির শেয়ারের দাম ৫০০ টাকা হওয়া উচিত নয়, তা এখন লেনদেন হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকায়। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে বাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি। সর্বোপরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকার ও দেশ।
স্টক এক্সচেঞ্জের নেতারা বলেন, সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বাজারে প্রচুর বিনিয়োগকারী এসেছেন। ফলে বেড়েছে শেয়ারের চাহিদা। সেই অনুযায়ী বাড়েনি শেয়ারের সরবরাহ। আর চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে এই ভারসাম্যহীনতাই বাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। অথচ সরকার বারবার ঘোষণা দিয়েও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির শেয়ার ছাড়তে পারেনি। এ কারণে বাজারে কোনো বিপর্যয় দেখা দিলে তার দায়দায়িত্ব সরকারের ঘাড়েই বর্তাবে। তাই শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন তাঁরা।
রাজধানীর একটি হোটেলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে গতকাল শনিবার প্রতিষ্ঠান দুটির নেতারা এভাবেই তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ সময় বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তাঁরা বলেন, নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য এখন বিনিয়োগের সঠিক সময় নয়। টাকা থাকলেই বিনিয়োগ করতে হবে—এমন কোনো কথা নেই। তা ছাড়া গুজবের ভিত্তিতে অতিমূল্যায়িত শেয়ার কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায়দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। ডিএসই-সিএসই-এসইসি বা সরকারকে দোষারোপ করে কোনো লাভ হবে না। কারণ আপনার টাকার প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক আপনি নিজেই।
শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতেই এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ। এতে বক্তব্য দেন ডিএসইর সভাপতি শাকিল রিজভী এবং সিএসইর সভাপতি ফখরউদ্দীন আলী আহমেদ। এ সময় দুই স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
শাকিল রিজভী বলেন, যত দ্রুত সম্ভব বাজারে শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এ জন্য বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে, সেগুলোর ৫১ শতাংশ সরকারের মালিকানায় রেখে বাকিগুলো বাজারে ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। এতে সরকার একদিকে প্রচুর টাকা পাবে, অন্যদিকে বাজারে স্থিতিশীলতাও আসবে। এখনই এটা করতে না পারলে বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ডিএসই-সিএসই যা সামাল দিতে পারবে না।
শাকিল রিজভী বলেন, প্রয়োজনে অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ খাতের নতুন কোম্পানি গঠন করে বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে সরকার। এর মাধ্যমে সরকার দেশের বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে শেয়ার-সংকটের সুযোগ নিয়ে যাতে কোনো খারাপ কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে না পারে, সেদিকেও সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
শাকিল রিজভী বলেন, ১৯৯৬ সালে শেয়ার-সংকটের সুযোগে বাজারে অনেক বাজে কোম্পানি ঢুকে পড়েছিল। যার বেশির ভাগই এখন দুর্বল মৌলভিত্তির ‘জেড’ শ্রেণীতে চলে গেছে। এসব কোম্পানিকে বাজারে আনতে যেসব ইস্যু ব্যবস্থাপকের ভূমিকা ছিল, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান তিনি।
ফখরউদ্দীন আলী আহমেদ বলেন, ‘কিছুদিন ধরে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, যেসব শেয়ারের মৌলভিত্তি ও লভ্যাংশ দেওয়ার নজির ভালো নয়, বিনিয়োগকারীরা সেদিকেই ঝুঁকে পড়ছেন। এ ধরনের বিনিয়োগ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ-ঝুঁকি বাড়ানোর পাশাপাশি বাজারের ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। তাই বিনিয়োগকারীদের বলতে চাই, আপনারা ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারে ব্যাংক ঋণ নিয়ে বা নিজের অন্য কোনো সম্পদ বিক্রি করে বিনিয়োগ করবেন না।’
ফখরউদ্দীন আলী আহমেদ বলেন, বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষাকৃত পুরোনো বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ নিয়ে বিনিয়োগ করেন। অনেক সময় তাঁরা এমন লোকের পরামর্শ নিয়ে থাকেন, যিনি নিজেই লোকসানে রয়েছেন। পেশাজীবী পরামর্শকের অনুমোদন না থাকায় বিনিয়োগকারীরা এভাবে যারতার পরামর্শ নিয়ে ঠকছেন। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত, পেশাজীবী পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া।
ফখরউদ্দীন আলী আহমেদ বলেন, বারবার ঘোষণা দেওয়ার পরও অজানা কারণে ২৬টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার এখনো বাজারে আসছে না। কাদের স্বার্থ সংরক্ষণে এসব কোম্পানির শেয়ার বাজারে ছাড়া হচ্ছে না, তা-ও খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, বাজারে সূচক বৃদ্ধি নিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জগুলো খুব একটা চিন্তিত নয়। ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ার ফলে সূচক বাড়লে তা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শেয়ারের মূল্য আয়ের অনুপাত (পিই রেশিও)। বর্তমানে বাজারে তালিকাভুক্ত এমন অনেক খাত রয়েছে, যেগুলোর পিই রেশিও ৭০ থেকে ৮০-এর ওপরে। কখনোই এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম এ অবস্থায় স্থায়ী হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, বর্তমান বাজারে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা খুবই দরকার। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (এসইসি) যেভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ফেলা হয়েছে, তার সঙ্গে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ একমত নয়। এসইসিকে এভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া উচিত হয়নি। এসইসির কর্মকাণ্ড চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে তাতে পুঁজিবাজার সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি, বিনিয়োগকারী সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শাকিল রিজভী বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে যতই মর্যাদার জায়গায় রাখা যাবে, ততই বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।
ফখরউদ্দীন আলী আহমেদ বলেন, এসইসিকে শক্তিশালী করতে লোকবল বাড়ানো দরকার। এ জন্য সরকারকে ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি বাজারের লেনদেনকে সহজ করতে আইনি কাঠামোর পরিবর্তন ও বন্ড মার্কেটকে জনপ্রিয় করার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া মূলধন বাড়ানোর নামে প্লেসমেন্ট-বাণিজ্যেরও সমালোচনা করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
Source : http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-10-10/news/100254